Tuesday, October 27, 2015

অসমাপ্ত স্বপ্ন



বুলেটটা ছুটে আসছে অসম্ভব দ্রুত গতিতে, ঠিক যেমনি করে বুলেটটির ছোটার কথা ছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনক মনে হলেও আমি বুলেটটির এগিয়ে আসার প্রতিটি ধাপ স্পষ্ট দেখতে পারছি। ইচ্ছে করলেই ছুটে গিয়ে আমি এখন বুললেটির গতি পরিবর্তন করে দিতে পারি, কিংবা নিজে সরে গিয়ে বুলেটের আঘাত করার রেঞ্জের বাইরে চলে আসতে পারি। অবিশ্বাস্য হলেও আমার এখন এর কোনটিই করতে ইচ্ছে করছে না। ভেতর থেকে আমি প্রস্তুত ছিলাম, এটা যে হবেই তা আমার জানা ছিল। কিংবা বলা যেতেই পারে এটা আমার স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে পরখ করার মত একটা বিষয়। কিংবা তোমাদের চোখে যা আত্মহত্যা, আমি সেটাই করছি এই মুহূর্তে…


    
   
    
   
    
   
হ্যাঁ, আমি জানতাম আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম একটা দীর্ঘ সময়। সাথে চমৎকার একটা স্বপ্নেও বিভোর ছিলাম লম্বা এই সময়টা ধরে। স্বপ্ন যা বাস্তবতাকে ছুঁয়ে তার সমমানের আরেকটা বাস্তবতায় রূপ লাভ করেছিল আমার নিউরন গুলির সহায়তায়। এই স্বপ্নটাকে যদি কেউ সিম্যুলেশন করে ধরে রাখতে পারত তাহলে নিশ্চিত এরচেয়ে নিখুঁত ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রোগ্রাম দুনিয়ার দ্বিতীয়টি হতে পারত না। কিন্তু আমার এই সময়টাতে প্রযুক্তি এখনো তত দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়নি, আর হয়নি বলেই সেটা সম্ভব হচ্ছে না। তবে সেই স্বপ্নটাতেও কিছু একটা ছিল, এমন কিছু যা আমার মস্তিষ্ককে ঠিকই বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একটা চমৎকার স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আমি সেই স্বপ্ন থেকে বের হতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত আমাকে সেই পথটাই বেঁছে নিতে হল যেটা সাধারণত কেউ বেঁছে নেয় না।
হ্যাঁ, স্বপ্নে আমাকে আত্মহত্যাই করতে হয়েছিল। আর এভাবেই ঐ স্বপ্নটার ইতি ঘটল।

ধারেকাছে কোথাও হুইসিল বেজে যাচ্ছে তারস্বরে। হুইসিলের শব্দটা যেন নিজেই নড়াচড়া করতে পারছে। একটু আগে ঐ হুইসিলের শব্দের উৎস যেমন অনেক দূরে মনে হয়েছিল এখন সেটা নিতান্তই নিকটে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আর একটু পরেই আমি সেই হুইসিলটাকে সহ হুইসিল বাদককে দেখতে পারবো।

হল ও তাই, চোখ ধাঁধানো আলো জ্বেলে একটা ট্রেন এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আর আমার অবস্থান ঠিক সেই ট্রেনটার চলার পথের মধ্যখানে। পায়ে খুব শক্ত করে সেঁকল লাগানো রয়েছে আমার। ইচ্ছে করলেও আমি এখন এই রেল পথ ছেড়ে বাইরে দাড়াতে পারব না। চরম ভয়ংকর একটা মুহূর্ত, বলা চলে আমার এই জীবনের শেষ মুহূর্ত এটা। কিন্তু আশ্চর্যজনক শোনালেও, আমি ভয় পাচ্ছি না। কোনরূপ অস্থিরতা আমাকে ছুঁতে পারছে না। নিশ্চল মানুষের মতই আমি নির্বিকারে দাড়িয়ে আছি রেল লাইনটার মধ্যে। ধীরে ধীরে ট্রেন এগিয়ে আসছে আমার দিকে। এত ধীরে যে আমি তার চাকার প্রতিটা সাইকেল পূর্ণ করার সময় পর্যন্ত গুনে দিতে পারব। সেই হিসেবে অফুরন্ত সময় আমার হাতে। কিন্তু এটাও নিশ্চিত, প্রতিটি মাইক্রো সেকেন্ড পার হচ্ছে আর নিশ্চিত মৃত্যু আমার দিকে ধেয়ে এগিয়ে আসছে…
   
    
   
     
   
     
  
হ্যাঁ, আমি এবারও আত্মহত্যা করেছি। কারণ আমার জানা ছিল মৃত্যু রূপে ঐ ট্রেন আমাকে কখনোই ছুঁতে পারবে না, বরং আমাকে সহায়তা করবে। আর হয়েছেও সেটাই। আমি এবারে সত্যিকার অর্থেই জেগে উঠেছি ঐ ঘুম থেকে।

অদ্ভুত, তাই না? আমি একটি ঘুমের মধ্যে আরেকটি ঘুমের স্বপ্ন দেখছিলাম, আর সেই স্বপ্নের ভেতর স্বপ্ন থেকে জেগে উঠবার জন্যে এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম যে নিজের পরোয়া পর্যন্ত করিনি। একটা ধারণার উপর ভিত্তি করে নিজেকে বসিয়ে দিয়েছি গান পয়েন্টের সামনে। তারপর যখন সেই স্বপ্নটা থেকে বের হয়ে আসলাম, বুঝলাম এটাও আমার আরেকটা স্বপ্ন। আর ততক্ষণে সেই স্বপ্ন থেকে আমাকে আবার জাগিয়ে তুলবার আরও অনেক ধাপ পার করে ফেলেছিল আমারই অবচেতন মন। আর এবারে সোজা ধরে নিয়ে দাড় করিয়ে দিয়েছিল একটা ট্রেন লাইনের উপর।

জেগে উঠলাম আবার। সেই পরিচিত জায়গা, সেই পুরনো গন্ধ বাতাস জুড়ে। আধো আলো আধো অন্ধকার পুরো ঘরটা জুড়ে। আসবাব সবই অস্পষ্ট, কিন্তু স্মৃতিকে ধার করে আমি সবই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কোথাও জেনারেটর কিংবা মেশিনের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। খুব সম্ভবত লোড শেডিং চলছে।

আলসেমির কারণে উঠে বসতে ইচ্ছে করছে না। মাথাটা ঘুরিয়ে দেয়ালে ঝোলানো ডিজিটাল ঘড়িটার দিকে তাকালাম। রাত এমন বেশি কিছু হয়নি, তবুও মেশিনের ঐ গুঞ্জন ছাড়া মোটামুটি চারিপাশটা নিশ্চুপ বলা চলে। অসময়ে ঘুমিয়ে পড়লে অবশ্য এমন অসময়েই জেগে উঠতে হয়।

পাশ ফিরে ঘুরতে গিয়েই ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। কিন্তু যতক্ষণে বুঝতে পারলাম ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। খুব মোটা কয়েকটা বেল্ট দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে একটা টেবিলের উপর আটকে রাখা হয়েছে আমাকে। খুব সম্ভবত আমার শরীরে এমন কিছুর প্রবেশ করানো হয়েছে, যার কারণে আমি কোন কিছুই অনুভব করতে পারছি না। অসাড় হয়ে পড়ে আছি টেবিলটার উপর। আর এটা বুঝতে পারার মুহূর্তেই চট করে মনে পড়ল যে মেশিনের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল সেটা মূলত কোন জেনারেটরের গুঞ্জন নয়। খুব ধীরে ধীরে পেন্ডুলামের ন্যায় দুলতে থাকা ধারালো এক যন্ত্রবিশেষ আমার দিকে নেমে আসছে। আর একে ধীরে ধীরে নামিয়ে আনার কাজটিই করছে একটা ছোট্ট মোটর। আবারও ঘড়ির দিকে তাকালাম, ঘড়ির সময়ের যদি কোন হেরফের না হয়ে থাকে তবে নিশ্চিত করে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমার মৃত্যু ঘটবে।

  
    
কিংবা কে জানে!
হয়ত এটাও একটি আত্মহত্যার প্রচেষ্টা, যা আমাকে জাগিয়ে তুলবে অদ্ভুত এই স্বপ্ন থেকে…

 
;