Sunday, October 26, 2014

কল্পগল্প : সময় ভ্রমণে হারানো ছেলেটি……



ইশতিয়াক খুব ছোটবেলাতেই বাবা-মা'য়ের সাথে স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় পাড়ি জমায়। সবকিছু ঠিকঠাক ভাবেই চলছিল তাদের। নিজেদের গুছিয়ে এনে তার বাবা একটা ছোট ব্যবসাও শুরু করেছিল। কিন্তু হঠাৎই একটা এক্সিডেন্টে ইশতিয়াকের বাবা-মা দুজনেই প্রাণ হারান। ইশতিয়াক তখন সবে মাত্র কলেজ উঠেছে। সময়টা খুব খারাপ ছিল তার জন্যে। মোটামুটি মেধাবী হওয়ায় স্কলারশিপটা পেয়ে যায়, কিন্তু বাবার ব্যবসাটা ধরে রাখতে পারেনি। আসলে ব্যবসা আর পড়ালেখা একসাথে চালিয়ে নেয়া সম্ভব ছিল না তার পক্ষে। তাই সেটাকে গুটিয়ে মোটামুটি একটা ব্যবস্থা করতে পেরেছিল। দ্রুতই অফিস সহকারী হিসেবে একটা পার্টটাইম জবও পেয়ে যায়। খারাপ সময়ে এই ছোটখাটো ব্যাপারগুলি তাকে খুব সহায়তা করে। এরপর বছর কয়েক বাদে ভার্সিটি শেষ করে সেখানেই ল্যাব ইন্সট্রাকটর হিসেবে জয়েন করে। এর মাঝে অবশ্য পি.এইচ.ডি. র জন্যে এপ্লাই করে রেখেছিল।

এমনিতে ইশতিয়াক খুব রিয়েলিস্ট ছিল, আবেগ গুলিকে খুব প্রশ্রয় দেয়নি কখনোই। এটাও অবশ্য বড় একটা পয়েন্ট ছিল তার এগিয়ে যাওয়ার পেছনে। কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে সে প্রায়ই ভাবতো, ভাবতো সময়টাকে যদি কোনভাবে পেছনে নিয়ে আসা যেতো। তাহলে হয়তো অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনাটা তার জীবনে এভাবে আসতো না। বিস্তর পড়াশোনাও করেছিল এই নিয়ে। ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং করেও সময়কে নিয়ে ফিজিক্সের প্রতিটা যুক্তিকে সে খুব গুরুত্ব দিয়ে আয়ত্ত করেছিল। তার অবসর সময়টাতে সে সময়টাকে পেছনে নেবার কৌশল নিয়েই কঠিন সব হিসেব করে কাটাত।

সে যেভাবেই তার সূত্রগুলিকে গুছিয়ে নিয়ে আসতো সব ঐভাবে ঠিকঠাক এসে একটা নির্দিষ্ট স্থানে থেমে যেতো। অতীত সময়ে বর্তমানকে নিয়ে যাবার প্রয়াস যেখানে শুরু সেখানেই তার সূত্রগুলি আর কাজ করতো না। কিন্তু এই পার্টটা চুকিয়ে ফেলতে পারলে সে খুব সহজেই অতীত সময়ে চলে যেতে পারে। হিসেব করে দেখেছে শুধু একটা অংশকে সে যদি কাল্পনিক মান ধরে নেয় তাহলে বেশ কয়েকটা উপায়ে সে অতীতে ফিরে যেতে পারে। কিন্তু কোন মানটাকে কল্পনা করবে আর কতটুকু ধরে কল্পনা করতে হবে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা।

একদিন ল্যাবে বসে এই নিয়েই ডুবে ছিল। তখন তার এক ছাত্র হুট করে বলল " স্যার সময় শেষ হয়ে এসেছে "। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল সত্যিই ল্যাবের সময় পার হয়ে গেছে। সে দ্রুত ডেস্ক ছেড়ে উঠে গেলে, ছাত্রদের কাজের অগ্রগতি দেখে তা নোট নিয়ে তাদের ছেড়ে দিতে লাগলো। সবার কাজ দেখতে দেখতে বেশ অনেকটা সময় চলে যায়। এরপর ছাত্রদের কাজের নোটটা আজকের দিনে এন্ট্রি করে আবার নিজের ডেস্কে গিয়ে বসে। সে যাবার আগে যেই টুকু করছিল সেখানে একটা সূত্রে কেবল মাত্র সময়টাকে বসিয়েছিল, কিন্তু তার মান দেয়নি। হঠাৎ কি মনে করে সে সময়ের মানকে কমিয়ে নিয়ে আসলো। তার সূত্রে এখন বর্তমান সময় অতীত সময় থেকে ধীর গতির, আর অতীত সময় স্ট্যান্ডার্ড সময় হিসেবেই এগিয়ে আসছে। এতটুকু দেখেই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। হ্যাঁ, এটাই তো সেই কাল্পনিক মান। সে যদি কোনভাবে বর্তমান সময়ের গতিটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাহলেই তো অতীতে প্রবেশ করতে পারবে। কিন্তু এখনো পুরো সমীকরণ সাজানো সম্পন্ন হয়নি। তাকে পুরোটা সাজিয়ে শেষ করতে হবে। বের করতে হবে ঠিক কি পরিমাণে সময়ের গতি তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

টানা কয়েক সপ্তা সে এই নতুন ধারণার উপর ব্যয় করলো। তার কষ্ট মোটামুটি সার্থকই বলা যেতে পারে। সে যখন বর্তমান সময়কে স্ট্যান্ডার্ড সময়ের এক চতুর্থাংশে রূপান্তর করছে তখন অতীত সময়ের গতি বর্তমান সময়ের উপর ওভার-লেপ করছে। অতীত ৩ গুন সময় পার করার পর বর্তমান অতীতের ৪র্থ সাইকেলের সাথে একটা সাইকেল পূরণ করছে। ফলে ৪ মিনিট সময় নষ্ট করে ৩ মিনিট পেছনে যাওয়া যাচ্ছে। লজিক্যাললি এই সবই প্রমাণ হচ্ছে যে শুধু সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই সে অতীতে ফিরে যেতে পারবে। কিন্তু সে তারপরও একে এভাবে প্রকাশ করতে নারাজ। কারণ এটা সম্পূর্ণই উদ্ভট একটা লজিক। সময়কে এখনো কোনরূপে সম্প্রসারণ কিংবা সংকোচন করা যায়নি। তাহলে কিভাবে সে এই সূত্র প্রমাণ করবে??

শুরু হল নতুন চেষ্টা, কিভাবে সময়কে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে সময়ের উপর প্রভাব পরীক্ষা করতে শুরু করলো। আলাদা আলাদা সূত্রে বসিয়ে সময়ের নিয়ন্ত্রন নিতে চাইলো। কিন্তু ধারাবাহিক ভাবেই প্রতিটার রেজাল্ট তাকে হতাশ করতে লাগলো। সময়ের ক্ষিপ্রতাকে সে কোনভাবেই বাগে আনতে পারছিল না। আর এর মাঝেই সে একটু বেশি পরিমাণে হতাশ, অমনোযোগী আর উগ্র হয়ে উঠছিল। ল্যাবের ছোট কয়েকটা ভুলের জন্যে সে দুজন ছাত্রের সাথে ইতোমধ্যে খারাপ ব্যবহার করেছে। ভার্সিটি কর্তৃপক্ষের কাছে এই খবর যাওয়ার পর তাকে ৬ মাসের জন্যে অফ ডিউটিতে পাঠানো হয়। এর মাঝে সে যদি মানুষিক উন্নতি করতে পারে তাহলে পুনরায় নিজের জব ফিরে পাবে, নয়তো বহিষ্কার করা হবে।

তাতে অবশ্য দমে যায়নি ইশতিয়াক। এমনিতেও নিজের কাজের বাইরে এইসব একরকম অসহ্য লাগছিল তার। চাকরিটা ছেড়েই দিবে চিন্তা করছিল। ওদিকে ব্যাংকে মোটামুটি কিছু টাকা পয়সা রয়েছে, শহরের বাইরে বছর খানিক কোন উপার্জন ছাড়াও খুব আরামেই কাটাতে পারবে সে। ভার্সিটির দেয়া রুমটা ছেড়ে দিয়ে কান্ট্রি সাইডের একটা বাসায় উঠলো পরের দিনই। খুব বেশি মাল-সামানা বলতে বাক্স ভর্তি বই আর বেশ কিছু ইন্সট্রুমেন্ট যা থিসিস করবে বলে আস্তে ধীরে জমাচ্ছিল। ছোট একটা ট্রান্সপোর্ট কারেই সব এঁটে গেল। সন্ধ্যার পরেই এপার্টমেন্টে গিয়ে উঠলো। বইয়ের বক্স গুলিকে এক কোনে রেখে ইন্সট্রুমেন্ট আর নিজের থিসিসের কাগজ গুলিকে বের করেই বসে পড়ল।

এভাবেই চলছিল, নিয়ম মত খাবার খাওয়ার কথাও ভুলে গিয়েছিল সে। মাঝে মধ্যে এমনও হয়েছে যে ২ দিনে একবার মাত্র বাইরে গিয়েছে খেতে। আর ঘুম! সেটা তাকে দেখলে মনে হয় পুরোপুরি বিসর্জন দিয়েছে। কিন্তু এর মাঝে কাজের কোন অগ্রগতিই হয়নি তেমন। সময়কে ধীর করার চেষ্টা করছিল সে। কিন্তু একই ভাবে দেখল বাস্তবে সময়কে কোনভাবে কমিয়ে আনতে পারছিল না। তাই সে ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে বসিয়ে চেষ্টা করছিল এই সময়টাকে কমিয়ে নিয়ে আসার জন্যে। কিন্তু কোনভাবেই এটার কোন কিনারা হচ্ছিল না, একেবারেই হতাশায় ডুবে যাচ্ছিল সে। এক সন্ধ্যায় যখন ঘর অন্ধকার করে গভীর ভাবে নিজের অসহায়ত্ব নিয়ে ভাবছিল, তখনই হুট করে মনে পড়ে আলোর গতির ব্যাপারটা।

আলোর গতি থেকেও যদি বেশি দ্রুত ছোটা সম্ভব হয় তাহলে হয়তো সময়টাকে সঙ্কুচিত করে আনা সম্ভব হবে। কিন্তু সেটার জন্যে তাকে এই গতিকে ভাঙ্গতে হবে। নতুন উদ্যমে চলতে থাকে কাজ। এবার বেশ জোরেশোরেই চালাতে থাকে। নতুন করে আলোর উপর চর্চা করতে থাকে। কিন্তু যতই এগিয়ে যায় ততটাই পেছাতে থাকে তার কাজের সম্ভাবনা। কারণ আলোর গতি থেকে দ্রুত ছোটা তখনও সম্ভব না। কিন্তু তাই বলে এভাবে হালও ছাড়তে রাজী নয় সে। ভিন্ন ভাবে চিন্তা করতে লাগলো। চিন্তা করতে করতে হঠাৎ খেয়াল হল, যদি আলোর গতিকে অতিক্রমই করা না যায় থাকুক, কিন্তু তাকে তো বিভাজিত করা যেতে পারে। যেখানে আলো তার নিজস্ব গতিতেই যাবে, কিন্তু সে সেই গতির ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে কাজ করতে পারবে। সপ্তাহ কয়েক পরিশ্রম করে একটা ফর্মেও চলে আসলো। যদিও সেটা সম্পূর্ণ নয়, কিন্তু লক্ষ্যের সন্নিকেটে চলে এসেছিলো।

এরই মাঝে ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তাকে যোগাযোগ করার জন্যে চিঠি পাঠিয়েছে। যাবে না যাবেনা করেও শেষ পর্যন্ত গেলো ভার্সিটিতে। অবশ্য অন্য একটা কারণও ছিল। এখন সে ভার্সিটিতে যেতে পারলে অনেক প্রয়োজনীয় ম্যাটেরিয়াল এবং শক্তিশালী কম্পিউটার ব্যবহার করে তার গবেষণাকে এগিয়ে নিতে পারবে। তার এই মানুষিক উৎফুল্ল অবস্থা দেখে ভার্সিটি কর্তৃপক্ষও পুনরায় তাকে নিয়োগ দিল, যদিও সাথে করে বেশ কিছু রেস্ট্রিকশন দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ইশতিয়াক তাতেও খুশি, কারণ সে ল্যাবটা পাচ্ছে। যদিও কাজ শুরু করার আগ্রহ দমিয়ে রাখতে পারছিল না কিন্তু বাধ্য হয়েই পুরো একটা মাস দাঁতে দাঁত চেপে সে তার প্রজেক্টের কাজ করা থেকে বিরত থাকলো। আসলে সেই অর্থে বিরতও থাকে নি একেবারে, এর মাঝেও বেশ অনেক গুলি যুক্তি সে সার্ভার কম্পিউটার থেকে চেক করে নিয়েছিল। মোটামুটি তার লজিক সবগুলিই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে পজিটিভ রেজাল্ট দিচ্ছিল তাকে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত পুরোটা চেক না করতে পারছে ততক্ষণ কোনভাবেই শান্তি পাচ্ছিল না মনে মনে।

মাসটি পেরুতেই সামার সেমিস্টার শুরু হয়ে গেলো, এই সেমিস্টারে তার কাজ কিছুটা কম থাকে। ল্যাব মোটামুটি ফাঁকাই থাকে, তাই ইচ্ছে মত নিজের কাজ নিয়ে নেমে পড়ল এই সুযোগে। সার্ভার কম্পিউটারে তার সকল লজিক এবং ডেটা গুলিকে ইন্সট্রাকশন আকারে ইনপুট দিতেই তার ৬ টি দিন চলে গেলো। এর পরের প্রায় ৪ দিন ডেটা প্রসেস করতেই ব্যস্ত থাকলো সার্ভার কম্পিউটারটি। ৪ দিন শেষে প্রাপ্ত রেজাল্ট দেখে ইশতিয়াক আনন্দে রীতিমতো চিৎকার দিয়েই ফেলেছিল।

এখন মোটামুটি নিশ্চিত তাকে কি করতে হবে। ১ বছরের ঐচ্ছিক ছুটি নিয়ে আবার চলে গেলো সেই কান্ট্রি-সাইট ফ্লাটে, সাথে নিয়ে গেলো প্রয়োজনীয় সকল ইন্সট্রুমেন্ট। স্টাডি রুম পুরোটা খালি করে ল্যাব তৈরি করলো। তার নিজের জমানো এবং বাবার ব্যবসার বেশ অনেক টাকা একত্রে খরচা করতে শুরু করলো প্রজেক্টের জন্যে। ইন্সট্রুমেন্ট সব একত্র করার পর সেই ছোট ল্যাবটাকে ল্যাব না বলে একটা ম্যাকানিকের জাঙ্গ স্টোরও বলা চলতো। টুলস আর মেশিনের ছড়াছড়ি ছিল রুমটা জুড়ে। রাত দিন জুড়ে নিজের মত কাজ করতে লাগলো। এর মাঝে তার পি.এইচ.ডি. আবেদনের কনফার্মেশন লেটারও আসলো। কিন্তু প্রোজেক্টের জন্য বাকি সব বাদ দিয়ে দিল সে। সাড়ে তিন মাস পর মোটামুটি তার প্রজেক্ট তার সামনে দাড়িয়ে গেল। দেখত ছোট্ট একটা টানেলের মত, উচ্চতায় তার নিজের সমান আর দৈর্ঘ্যে ১২ ফিট। টানেলের দু'পাশেই ভারী সব যন্ত্রপাতিতে ভরপুর।

এবার পরীক্ষা করার পালা, কিন্তু কিভাবে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হবে সব ঠিকঠাক মত হচ্ছে?? একবার সেট করে অতীতে পাঠানো শুরু করলে তো আবার গিয়ে অতীত থেকে চেক করে আসা সম্ভব নয়। আবার এমন হুট করে এমন কাউকেও পাওয়া যাবে না যাকে এই প্রোজেক্টে টেস্ট সাবজেক্ট হিসেবে কাজ করতে রাজী করাতে পারবে। আবার নিজের আগ্রহের কারণে অন্য কাউকে হুট করে জানাতেও ইচ্ছে হচ্ছে না। এইসব তালগোল পাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলল, সে নিজেই নিজেকে দিয়ে পরীক্ষা চালাবে। বাইরে এমনিতেও তেমন কোন জরুরী কাজ নেই। সবকিছু একটা কম্পিউটারে সেট করা থাকবে। যতটুকু সময় সে পেছনে যেতে চায় ততটুকু সময় পর্যন্ত এই সিস্টেমটা চলতে থাকবে। তারপর বাকিটা ঠিকঠাক চললে সে থাকবে কাঙ্ক্ষিত অতিতে।

ঠিক করলো রবিবার সে এই টেস্ট চালাবে, হাতে আছে চারটা দিন। সময়টাকে কাজে লাগলো সে। তার পুরো থিসিসের বর্ণনা বিস্তারিত ভাবে লিখতে শুরু করলো। প্রতিটা সূক্ষ্ম হিসেব পর্যন্ত লিখে শেষ করতে করতে শুক্রবারে পৌঁছল। ইশতিয়াক ধর্মকর্মের প্রতি কখনোই তেমন মনোযোগী ছিল না, তবুও শেষ বারের মত প্রার্থনা করতে গেলো। পুরোটা পথ সাইকেলে চড়ে আসলো গেলো। সন্ধ্যার পর দামী একটা রেস্তোরা থেকে সুস্বাদু দামী খাবার দিয়ে ভুরি ভোজ করল। তারপর সরাসরি চলে গেলো সিনেমা দেখতে, যদিও সিনেমাতে কি দেখছিল তাতে কোন আগ্রহ কাজ করছিল না। সময়টাকে নষ্ট করার তার মূল লক্ষ্য ছিলো। শেষে ফিরল নিজের ফ্লাটে। এই দীর্ঘ সময়ের ক্লান্তি কাটাতে একটা রাত আর পরের অর্ধেক দিন নিয়ে নিল তার। ঘুম ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে দুপুর হয়ে গেলো। উঠেই দ্রুত চলে গেলো তার ল্যাবে। সবকিছুকে আবার আগা গোঁড়া চেক করতে বসে পড়লো। আজ রাতেই সে নিজেকে নিয়ে দুঃসাহসিকতা দেখাবে এই যন্ত্র-দাবনের মাধ্যমে।

পুরোটা বিকেল আর সন্ধ্যা লাগিয়ে চেক করলো ইশতিয়াক। সবকিছুই প্লান অনুসারে ঠিকঠাক আছে। ডিনার শেষ করে কম্পিউটারে হিসেব মোতাবেক সময়টাকে সেট করলো ঠিক তার বাবা-মায়ের এক্সিডেন্টের আগের দিনে। তারপর কাউন্ট ডাউন শুরু করে গিয়ে দাঁড়ালো টানেলের এক প্রান্তে। ধীরে ধীরে কাউন্ট ডাউন শেষ হতেই ধীরে ধীরে গুঞ্জন তুলল তার যন্ত্রদানব। প্রথমে মৃদু শব্দে আর অল্প আলোক উজ্জ্বলতায় শুরু হল কার্যক্রম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দৃষ্টিতে অসহ্য আলো আর বিকট শব্দ তৈরি করতে শুরু করলো সেটা। কানে হাত চেপে অসহ্য হয়ে চিৎকার শুরু করলো সে....





‗‗‗ ইন্সিডেন্ট # ১ ‗‗‗
‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾

ঠিক কত সময় চিৎকার করেছে সেটা জানে না। কিন্তু মনে হল অন্তত কাল ধরে সে চিৎকার করেই যাচ্ছে। আর প্রতিমুহূর্তে তার চিৎকার তার কাছেই আরও শক্তিশালী হয়েই ফিরে ফিরে আসছে। শরীরের প্রতিটা কোষের মধ্যে অগ্নিদগ্ধয়ের জ্বালা অনুভব করছিলো সে। ইচ্ছে করছিল ছুট লাগায় কিন্তু ছুট লাগাবার মত কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছিল না। অসহ্য এই যন্ত্রণা চলতে থাকলো, চলতেই থাকলো বিরামহীন ভাবে......



‗‗‗ ইন্সিডেন্ট # ২ ‗‗‗
‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾

হুট করেই সব যন্ত্রণার অবসান ঘটলো। সকল গুঞ্জন থেমে গেলো, মনে হল তার পুরো কাজ ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মজার ব্যাপার আলো যেমন উজ্জ্বল ছিল ঠিক তেমনই উজ্জ্বল রয়েছে এখনো। তবে সেটাও আর অসহ্যের পর্যায়ে নেই। আলোক কিরণ গুলি যেমন ছুটে যাচ্ছিল তাকে স্পর্শ করে। কিন্তু সে কোথায়?? তার শরীরটা কোথায় পৌঁছালো????



‗‗‗ ইন্সিডেন্ট # ৩ ‗‗‗
‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾

হুট করেই উঁচু স্থান থেকে পড়ে যাবার মত করে দ্রুতগতিতে পড়তে শুরু করলো। হ্যাঁ, এখন নিজের শরীরটার অস্তিত্ব আবার অনুভব করতে পারছে। বাতাসের ঘর্ষণ অনুভব হচ্ছে এখন। পিছনের দিকে বাতাসের ঘর্ষণ কিছুক্ষণের মধ্যেই পিড়া দিতে শুরু করলো। চামড়া যেন হাড় ভেঙ্গে উল্টো দিকে চলে আসতে চাইছে। বিরামহীন ভাবে এই পড়ে যাওয়া চলতেই থাকলো, কিছু একটা ধরার জন্যে হাত পা ছুটাতে লাগলো। কিন্তু আঁকড়ে ধরার মত কিছুই পেলো না......



‗‗‗ ইন্সিডেন্ট # ৪ ‗‗‗
‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾‾

ঝুপ করেই সব অন্ধকার হয়ে গেলো। প্রচণ্ড ধাক্কা অনুভব করলো পিছনের দিকে। ব্যথায় শরীর কুঁকড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু হাত-পা নাড়ানোর মত কোন শক্তি যোগাড় করতে পারছিল না হাজার চেষ্টা করেও। মস্তিষ্কের ভেতরে চিনচিনে একটা অসহ্য ব্যথা শুরু হয়ে গিয়েছিল এরই মাঝে। হয়তো হিসেবে কোথাও বিরাট গোলমাল রয়ে গিয়েছিল। কিংবা তার মেশিনটা কোন কারণে ঠিক মত কাজ করেনি। এইসব করতে করতেই চেতনা হারাতে শুরু করল......



… … … … … … … … … … … …





নিজেকে স্কুলের একটা খেলার মাঠে ঘাসের উপর আবিষ্কার করল ইশতিয়াক। মাটিতে পড়ে আছে সে। এখানে কি করে এলো?? রাত একেবারেই শেষ পর্যায়ে, ভোরের আলো দেখা যাচ্ছে। ব্যথায় সাড়া শরীর নাড়ানো দায়। নিজেকে চরম আকারের আহাম্মক মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে। ওভাবেই পড়ে থাকলো বেশ কিছুক্ষণ। আস্তে আস্তে ঝিম ধরা এই ব্যথা কমতে শুরু করলো। মোটামুটি যখন চারিদিকে আলো ফুটে গেছে তখন উঠে দাঁড়াবার মত শক্তি পেলো। এখন সে নিশ্চিত তার যন্ত্রদানবে কোথাও কোন ভুল রয়ে গিয়েছিল। তাই তো যা হবার তা না হয়ে উল্টো মানুষিক আর শারীরিক কষ্ট গুলি পেতে হল তাকে। কিন্তু এখানে কি করছে সে? নাকি মেশিন সত্যিই কাজ করে গেছে?? এই মুহূর্তে চিন্তা করার সময় নেই। দ্রুত তাকে বেরুতে হবে স্কুলের ভেতর থেকে। নয়তো এখুনি হাজতে ঢুকতে হবে অনুমতি ব্যতীত এখানে আসার অপরাধে। দ্রুতই মাঠের তারের বেষ্টনী পার করে বাইরে চলে আসলো।

এই প্রথম পরিবর্তনটা লক্ষ্য করলো সে। রাস্তাগুলি অনেকটা সেকেলে এবং অনেকটা অপ্রশস্ত। স্মৃতি হাতড়ে বেড়াতে বেড়াতে দেখল সে আসলে এই রাস্তাটার সাথে খুব পরিচিত। এখনো মনে আছে বামে দিয়ে কিছুদূর এগোলেই একটা আইসক্রিম শপ পড়বে। দ্রুত বামের রাস্তাটা ধরে হাটতে শুরু করলো। তার ধারণা একদম সঠিক প্রমাণ করে স্কুলের পেছনের সেই আইসক্রিম শপটা দেখতে পেলো। আর অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এটা ঠিক ঐ রূপেই দেখছে যেমনটা সে ৮ বছর পূর্বে দেখেছিল!!!! এর মানে তার প্রজেক্টের, এত নিরলস পরিশ্রম, নির্ঘুম রাতগুলি বৃথা যায়নি। তার যন্ত্রদানব তাকে ঠিকই নিয়ে এসেছে ঐ সময়ে। আনন্দে রাস্তায় দাড়িয়েই বাঁদরের মত হাত-পা ছুড়ে নাচতে আরম্ভ করলো।

হুট করেই মনে পড়লো এভাবে সময় নষ্ট করা একদমই উচিৎ হচ্ছে না। আর কিছুক্ষণ বাদেই তার বাবা-মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে। আর বেরিয়ে গেলেই তার এতসব কষ্ট সব বৃথা হয়ে যাবে। দৌড়াতে শুরু করলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। স্কুল থেকে খুব দূরে নয় তার বাড়ি, এমনিতেও সে হেটেই স্কুল থেকে বাড়িতে যেতো। কলেজে উঠার পর বাসে আসা যাওয়া করতে শুরু করেছিল। মিনিট ১০ বাদেই নিজের বাড়ির সামনে চলে আসলো। ঐ তো তাদের গাড়িটা দেখা যাচ্ছে ড্রাইভ ওয়েতে। এখুনি তার বাবা আর মা বেরুবে। সে গিয়ে গাড়িটার সামনে দাঁড়াল। আর তখনই দরজা খুলে প্রথমে তার বাবা আর তারপর মা বেরিয়ে আসলো। মনে পরলো ঐ সময়ের কলেজ পড়ুয়া ইশতিয়াক তখনও ঘুমোচ্ছে। তারা কেউ তাকে ডেকে দিয়ে যায়নি। ঘণ্টা খানিক বাদেই সেই ইশতিয়াক ঘুম থেকে উঠেই ছুট লাগাবে কলেজের উদ্দেশ্যে। টেবিলের উপর তার জন্যে নাস্তাটা পর্যন্ত রেডি করে রেখে গেছে আম্মু।

বাবা দ্রুত এসে গাড়ির সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। ইশতিয়াক যে গাড়ির পাশে দাড়িয়ে আছি সেটা যেন তিনি দেখতেই পায়নি। ইশতিয়াকের কিছুটা রাগ লাগলো তাতে। কিছুই না বলে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল, আস্তে করে ডাকলো "বাবা" বলে। কিন্তু কোথায় কি? তার বাবা যেন সেই ডাক শুনতেই পায়নি, নিজের মনে রেডিয়েটারের পানির মাপ দেখছে। ওপাশে চেয়ে দেখলো তার আম্মু্ও গাড়ির দরজার সামনে দাড়িয়ে। আশ্চর্য! তাকে চিনতে না পারুক, অন্তত অপরিচিত একজনকে দেখে হ্যালো তো বলবেই। কিন্তু কিছুই না! তার বাবা-মা তো এমন স্বভাবের ছিল না। উল্টো মিশুক হিসেবেই পরিচিতি ছিল তাদের প্রতিবেশী মহলে।

এটা দেখে রেগে গিয়েই গলা চড়িয়ে মা'কে উদ্দেশ্য করে বেশ জোরেই বলল, "এই যে শুনছেন??"

ওমা! এতেও তার আম্মুর কোন ভাবান্তর নেই!! এটা কি করে সম্ভব!!! এবার রাগ সহ্য করতে না পেরে একেবারেই আম্মুর সামনে গিয়ে দাড়ালো। কিন্তু উনি ইশতিয়াককে ভেদ করেই যেন তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে। এইবার ইশতিয়াক আশ্চর্য না হয়ে পারলো না। ঘুরে দাড়াতেই গাড়ির দরজার পাশের আয়নায় চোখ পড়লো, নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না সে। এইটা কি করে হয়!!!!


আয়নায় শুধুই তার আম্মুকে দেখা যাচ্ছে। ইশতিয়াক তার সামনেই দাড়িয়ে, কিন্তু আয়নায় তার কোন প্রতিবিম্ব নেই। কিছুই নেই....!!!







_________________________
‗‗‗ ওদিকে এপার্টমেন্টে ‗‗‗
──────────────────



আশে পাশের এপার্টমেন্টের মানুষগুলো রাত করে প্রচুর শব্দ শুনতে পারছিল উদ্ভট ছেলেটার রুম থেকে। বিরক্ত হয়ে বেশ কয়েকবার করে দরজায় নক করে, ধাক্কা দিয়ে সাড়া না পেয়ে শেষে পুলিশ ডাকার ভয়ও দেখাচ্ছিল বাইরে দাড়িয়ে। তাতেও যখন কোন সাড়া দিচ্ছিল না ভেতর থেকে তখন একজন সত্যি সত্যিই পুলিশে খবর দেয়। কিন্তু পুলিশ আসার আগেই এপার্টমেন্টের ভেতরে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হয় এবং প্রায় সাথে সাথেই পুরো এলাকাটা অন্ধকার হয়ে যায়।

এর কিছুক্ষন পরেই ঘটনাস্থলে পুলিশ এসে রুমের দরজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে। একটা রুম থেকে ধোয়া বেরুতে দেখে ঐ রুমে গিয়ে বিস্ফোরণের উৎস দেখতে পায়। একটা টানেলের মত জিনিষের সাথে অনেক যন্ত্রযুক্ত ছিল। বিস্ফোরণটা ওখানেই হয়েছে। প্রায় সবকিছুই পুড়ে গেছে, গলে গেছে প্লাস্টিকের মত জিনিষ ছিলো। প্রচণ্ড তাপে রুমের হার্ডবোর্ডের দেয়াল পর্যন্ত বেকে গেছে। কিন্তু সেই উদ্ভট ছেলেটাকে কোথাও পাওয়া যায় নি।

পুলিশের বিশেষ বিভাগের লোক এসে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুড়ে যাওয়া কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক, আর টানেলে সংযুক্ত বিশেষ কিছু যন্ত্র পরীক্ষা করার জন্যে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এত বাজে ভাবে কম্পিউটারের হার্ডড্রাইভ গুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে কোন ডেটাই সেখান থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।


শেষ পর্যন্ত মানুষিক ভারসাম্যহীন হারানো ব্যক্তিদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল ইশতিয়াকের নাম।



────────────────────────────────────
♦ অতিমাত্রায় কাল্পনিক গল্প, তাই যুক্তিনির্ভর কোন ব্যাখ্যা এর থেকে প্রদান করা সম্ভব নয়।
 
;