Monday, July 27, 2015

অনুগল্পঃ মোহনার অপার্থিব ছায়া



হুট করেই স্যাঁতস্যাঁতে একটা অনুভূতি ঘিরে ধরল মোহনাকে। মনে হচ্ছে জোড় করে কেউ তার গা ভরে শ্যাওলা ঘষে দিচ্ছে । বিরক্তিকর একটা অনুভূতি। হাত থেকে মোবাইলটা রেখে বিছানায়ই একটু আড়মোড়া ভাঙ্গবার জন্যে হাত-পা ছুড়ে দিল। তারপর আবার মোবাইল হাতে ফেসবুকে ডুবে গেলো।

বেশ অনেকক্ষণ পার হবার পরেও যখন সেই অনুভূতিটাকে পিছু ফেলতে পারছিল না তখন বিরক্ত হয়েই বিছানায় মোবাইল ফেলে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে আবার ফিরে আসলো রুমে। বাইরে এলোমেলো বাতাস বইছে, গত ক’দিনের তুলনায় পরিবেশ আজ বেশ ঠাণ্ডা। সম্ভবত বৃষ্টিও শুরু হয়ে যাবে কিছুক্ষণের মাঝেই। বিছানায় আর এখন যেতে ইচ্ছে করছে না। যদিও বাইরে অন্ধকার, তবুও জানালার পাশে এলোমেলো বাতাসেই বসতে ইচ্ছে হচ্ছে।

জানালাটার কাঁচ অল্প খুলে দিয়ে বসে পড়লো পাশে থাকা সোফাটার উপর। কিন্তু মোবাইলটা তো ছেড়ে এসেছে বিছানাতেই, তাই আবার উঠে গিয়ে বিছানা হতে মোবাইলটা তুলে নিয়ে এসে বসল সোফায়। ফেসবুকটা চালু করে একটা স্ট্যাটাস লিখল- ” অপার্থিব অন্ধকারে এলোমেলো হাওয়ার তোড়ে উড়ছে মন, উড়ছে অনুভূতিরা”। পোষ্ট দেবার কিছুক্ষণের মাঝেই বন্ধুরা তাতে লাইক দিতে থাকলো। দু’একজন মজার কমেন্টও করলো।

ওগুলির রিপ্লাইই দিচ্ছিল সে, এর মাঝে শুরু হয়ে গেলো ঝুম বৃষ্টি। বাতাস আর বৃষ্টির তোড়-জোরেই জানালা বন্ধ করতে হল। তারপর আবার গিয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়লো মোবাইল হাতে। এর মাঝে আরও কয়েকজন মন্তব্য করেছে তার ঐ পোষ্টে। তবে সেসবের মাঝে অপরিচিত একজনের মন্তব্য চোখে পড়ল।

মোহনা সাধারণত পাবলিক পোষ্ট দেয়না। তার সব পোষ্টই মোটামুটি বন্ধুদের দেখার মত করে দেয়। সেখানে অপরিচিত কারও মন্তব্য আসার প্রশ্নই আসে না। চিন্তা করতে করতেই মনে পড়ল আজ দুপুরে পাশের বাসার পিচ্চিটা এসেই তার মোবাইল হাতে নিয়েছিল গেইমস্‌ খেলার জন্যে। হয়তো সেই সময়েই ভুল করে পিচ্চিটা ঝুলে থাকা কোন রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে নিয়েছে। আর সেখান থেকেই এসেছে এই অপরিচিত। এই একজনই এড হয়েছে নাকি আরও এসেছে এই ফাঁকে, কে জানে? এখন আর চেক করতে ইচ্ছে করছে না, কাল বসে দেখতে হবে সেটা।

তবে মন্তব্যটা কেমন যেন। হয়তো অপরিচিত বলেই মন্তব্যটা ভালো মনে হয়নি তার। লিখেছে- “অপার্থিবে উড়ে বেড়ায় এমন অনেক কিছুই পার্থিব এই জগত মনে নিতে পারে না”। এটা কেমন মন্তব্য। আধারটাকে বোঝাতে না হয় অপার্থিব শব্দটা ব্যবহারই করেছিল, কিন্তু তাই বলে প্রসঙ্গের বাইরে গিয়ে এমন একটা মন্তব্য করতে হবে? নাহ্, ঝামেলা বিদায় করতেই হবে। নয়তো দেখা যাবে প্রতি পোষ্টেই এমন অপ্রাসঙ্গিক কথা টেনে আনছে।

ভাবনা অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে আইডিটার উপর ক্লিক করলো, আর অবাক হয়ে দেখল আইডিটা নেই। হয় এরই মাঝে আইডি ডি-একটিভ করেছে লোকটা আর নয়তো মন্তব্যের রিপ্লাই না পেয়ে নিজেই তাকে ব্লক করেছে। যাক, তবুও নিজে থেকেই ঝামেলার বিদায় হয়েছে, এই শান্তি।

বৃষ্টি শুরু হবার পরপরই আরও ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে শ্রাবণ মাসে মাঘ মাসের শীত নেমে এসেছে। অল্প অল্প কাপনিও হচ্ছে ঠাণ্ডায়। এত কিছুর মাঝেও সেই স্যাঁতস্যাঁতে অনুভূতিটার পিছু ছাড় হয়নি। এখনো সেই একই অনুভূতি তাড়া করে ফিরছে।

বিরক্তি যখন একদম চরমে ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা। কি যেন তার ভেতর পর্যন্ত ছুঁয়ে গেলো। এই অনুভূতিটা এতটাই বাস্তব যে, তার অন্তরও সেই ছুঁয়ে দেয়া অনুভূতিটা টের পাচ্ছে। ঠিক এর পরপরই চোখ পড়লো দেয়ালে বাধাই করা নিজের ছবিটার দিকে। তবে ঠিক ছবিটা নয়, ছবির ফ্রেমের উপর গ্লাসে যে ছায়াটা দেখা যাচ্ছে সেটাই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

আবছা মত প্রায় মানুষের আকৃতির কিছু একটা ভেসে আছে, আর সেটারই রিফ্লেকশন হচ্ছে ফ্রেমের গ্লাসটাতে। চট করেই চোখ ঘুরিয়ে উল্টো দিকে দেখল মোহনা। মাটি থেকে দু’তিন হাত উঁচুতে কি জানি একটা ভেসে বেড়াচ্ছে। ওটা দেখে এতটাই অবাক হল যে চিৎকার করতেও ভুলে গেলো। কিংবা কে জানে, হয়তো ভয়েই চিৎকার করতে পারছিল না।

দেখতে মানুষের আকৃতির মত হলেও ওটাকে মানুষ বলা ঠিক হবে না। আবছা একটা ছায়ার মত, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওটাও যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। স্যাঁতস্যাঁতে অনুভূতিটা আরও বাড়তে শুরু করেছে এখন। আরও মনে হচ্ছে ভাসতে থাকা ঐ ছায়াটা তার ভেতর পর্যন্ত সব পড়ে নিচ্ছে। নিজের ভেতর যেন আর কিছুই লুকানো নেই।

ধীরে ধীরে সেই উড়ন্ত ছায়াটা কাছে আসছে তার। এইতো আর এক হাত দূরত্বে আছে, আরও কাছে আসছে। আরও কাছে….. হুট করেই সব যেন অন্ধকার হয়ে গেলো।







সকালে এসে আম্মুই ডেকে দিয়ে গেলো। সোফাতে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। হুট করেই রাতের ঘটনাটা মনে পড়ে গেলো। নির্ঘাত স্বপ্ন দেখেছে। এমন কি সত্যিই হয় নাকি? রাতের স্ট্যাটাসের ঐ অপার্থিব শব্দটা আর ঐ শব্দ নিয়ে করা মন্তব্যটা নিশ্চয় মাথায় গেঁড়ে বসেছিল। আর তাই ঘুমবার পরপর সেটা নিয়েই উদ্ভট স্বপ্ন দেখেছে। নিজের মনে হাসতে হাসতে গিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকল। ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে আয়নায় নিজেকে দেখছিল। আবার সেই স্যাঁতস্যাঁতে অনুভূতিটা যেন ফিরে আসছে।

দ্রুত করে ব্রাশ শেষে চোখে মুখে পানি দিতেই আবার ব্যাপারটা ঘটতে শুরু করল। ঝট করে চোখ উঠিয়ে আয়নায় দেখল। নিজের দিকে কিংবা আরও ভালো করে বলতে গেলে নিজের চোখের দিকে তাকিয়েই শিউরে উঠলো সে। দেখতে পেলো সেখানে যেন একের পর এক মোহনা দাড়িয়ে আছে তার সামনে। কিন্তু কেউই মাটিতে দাড়িয়ে নেই। সবাই মাটি থেকে একটু উঁচুতে গতকালের দেখা ঐ ছায়াটার মত ঝুলছে…



 
;