Saturday, September 20, 2014

অপরিচিত এই অন্ধকারে...



ল্যাম্প পোষ্টের নিচে দাড়িয়ে আছি। না, যেদিকটাতে আলো পড়ে সেই দিকটাতে না তার উল্টোদিকে। আলোর আভা আমার গায়েও লাগছে কিন্তু অন্ধকারে এইটুকু আলোর জন্যে অন্ধকারটাকে আরও আপন মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে। কাছাকাছি আরও দুইটা ল্যাম্পপোস্টের কোনটাতেই আলো নেই। কে জানে হয়তো লাইট গুলিই চুরি গেছে, আলো দেয়া তো এখন অনেক দূরের ব্যাপার। এ শহরের কেউ যেমন তাদের এই সম্পত্তিগুলির খেয়াল রাখে না আমিও তেমন একজন। কিন্তু আজ চোখে পড়ছে, কারণ এই অন্ধকারে তৈরির পেছনে যেই সম্পদ গুলি হারিয়েছে আমিও তেমন হারিয়েছি। অন্ধকারটাকে আপন মনে হচ্ছে আর সত্যি কথা বলতে কি আলো না থাকাতেই যেন স্বস্তি পাচ্ছি এই মুহূর্তে। অন্য কোন সময় হলে হয়তো ব্যাপারটা ভিন্ন রকম হত।

রাস্তার ওপারের কলোনির ৩ তলা বিল্ডিংটাতে আমার বসবাসের স্থান ছিল আজ বিকেলেও। কিন্তু বিকেলটা শেষ হতেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। জানলাম আমি এতদিন যে বিশ্বাস নিয়ে বড় হয়েছি সেই বিশ্বাসের কোথাও আমার অবস্থান নেই।

বিকেলে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন ঐ বাসায়। তাকে আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। কিন্তু বাবার মুখটা হুট করেই তাকে দেখে কেমন যেন শুকিয়ে গেলো। যদিও খুব ভদ্রভাবে তাকে বসার ঘরে নিয়ে বসালেন, তারপর বেশ পরিচিত ভঙ্গীতেই কেমন আছে, কি হাল এইসব জানতে চাইছিলেন। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম বাবা চাচ্ছিলেন না এই লোকটি এখানে আরও ১ টা মিনিটও অপেক্ষা করুক। যেন দ্রুত কথা বলে বিদায় করে দিতে পারলেই বাবা বাঁচেন।

আম্মা আমাকে ভেতরের রুম থেকে ডাকলেন। তারপর হাত ধরে নিয়ে আমার রুমটাতে নিয়ে এসে কেমন যেন ঝটপট বুঝিয়ে ফেলার ভঙ্গীতে বলতে থাকলেন-
"এই লোক কিছু বললে বিশ্বাস করবি না একদম। এই লোকের কথায় কিছু আসে যায় না। তুই যেমন আছিস এমনই থাকবি, বুঝেছিস।"
আমি ঠিক বুঝি নি, তবে এটা বুঝেছি আম্মা আসলে কথাগুলি আমাকে বলেন নি। আসলে কথাগুলি সে নিজেকেই বলেছেন আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে। আমিও আম্মার কথা মত দ্রুত বোঝার ভঙ্গী করে বললাম বুঝেছি। তারপর আম্মা আমাকে রুমে রেখেই চলে গেলেন লোকটির সাথে বাবা যে রুমে কথা বলছেন সেই রুমে।

অস্পষ্টভাবে এখান থেকেই শুনতে পারছিলাম তারা কোন একটা ব্যাপারে একমত হতে পারছে না, কথা কাটাকাটি করছে। অকারণেই বুঝে নিয়েছিলাম কোথাও একটা সুর কেটে গেছে এই সময়টার ভেতরেই। এর মধ্যেই আব্বা হুট করে রুমে ঢুকে আমাকে টেনে বসার রুমে নিয়ে গেলেন আর বললেন -

"এই ছেলে যদি আপনারই হয় তাহলে এতদিন কি করেছেন? ওখানে কেন ছেড়ে এসেছিলেন ছেলেকে? এতই মায়া তাহলে তখন কেন মায়ায় কমতি পড়েছিল?"

হুট করে কথাগুলি শুনে কেমন যেন ঘোরে চলে গিয়েছিলাম। বাবা এরপরও কি যেন বলছিল খুব উত্তেজিত হয়ে। আবার সেই লোকটাও সমান তালে উত্তেজিত হয়েই কথার উত্তর দিচ্ছিল। কিন্তু কোন কথাই আমার কানে ঢুকছিল না। এক মুহূর্তেই পুরো দুনিয়াটা উল্টে গিয়েছিল আমার জন্যে।

এরপর ঐ ঘোর লাগা অবস্থাতেই ছুটেছিলাম, ঘর ছেড়ে বিল্ডিং থেকে নেমে রাস্তা ধরে ছুটছিলাম। হাঁপাতে হাঁপাতে পড়ে যাবার ঠিক আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ঐভাবেই ছুটছিলাম আমি। হোঁচট খাবার পরেই ঘোরটা কাটল। চারপাশে তাকিয়ে দেখি সবাই কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছিল বাবার কথাগুলি এরাও সবাই জেনে গেছে এরই মাঝে। রাস্তা থেকে দ্রুত উঠে ফুটপাতেই বসে পড়লাম। তখনও চরমভাবে হাঁপাচ্ছিলাম। বার বার আম্মার কথাগুলি কানে বাজছিল-
"এই লোক কিছু বললে বিশ্বাস করবি না একদম। এই লোকের কথায় কিছু আসে যায় না।"
কিন্তু ঐ লোক কিছু বলার আগে আমার বাবা এইসব কি বলল তাহলে? কেন বলল কথাগুলি?

চোখ ফেটে কান্না আসছে, কিন্তু আমি কান্নাও করতে পারছি না। কেমন যেন হাসফাস হচ্ছিল ভেতর ভেতর। বারবার মনে হচ্ছিল বাবা ঐসব মিথ্যা বলেছিল। এমন তো হতেই পারে না। আমার তো এখনো স্পষ্ট মনে আছে বাবা আমাকে কাঁধে করে নিয়ে হাঁটছে, ঘুমপাড়ানোর চেষ্টা করছে। তাহলে এমন কথা কেন বলবে বাবা। এটা হতেই পারে না। মনে হচ্ছিল আমি ভুল শুনেছি, বাবা অন্য কিছু বলেছিল। আমিই ভুলে কথাগুলি এমন শুনেছি।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। ফুটপাতে এত সময় বসে আছি দেখে কয়েকজন কেমন করে তাকাচ্ছেও। তার মধ্যে পড়ে গিয়ে হাঁটুর অনেক বড় অংশের চামড়া উঠে গেছে। একটু একটু রক্তও বের হচ্ছে সেখান থেকে সাথে জ্বালা করছে অনেক। কিন্তু মনের ভেতর যেই জ্বালা হচ্ছে তার কাছে এই জ্বালা কিছুই না। আমি শুধু বারার চাইছিলাম এই দুঃস্বপ্নটা ভেঙ্গে জেগে উঠি। উঠে দেখি আম্মা আমার জন্যে বিকেলের নাস্তা রেডি করছে। কিন্তু জাগতে আর পারছি কই। জ্বলে-পুড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছি আমি।

ফুটপাত ছেড়ে উঠে আবার হাটা শুরু করলাম। হাঁটছি, কোনদিকে খেয়াল করা ছাড়াই হাঁটছি। মাঝে মধ্যে এর ওর সাথে ধাক্কাও লাগছে। দুই একজন আবার "পাগল নাকি" বলেও সম্বোধন করছে। কিছুই গায়ে লাগছে না এখন আর। ঘোর লাগা মুহূর্তটা আবার ফিরতে শুরু করেছে মনে হয়। সত্যিকারের একটা পরিচয় ছাড়াই আমি মিথ্যা পরিচয়ে এতটা বড় হয়ে গেছি, সেটাই ভাবছি বার বার। হাটতে হাটতে কখন এই কলোনির সামনে ল্যাম্প-পোষ্টের নিচে চলে এসেছি তা খেয়াল করি নি। খেয়াল হল যখন অন্ধকারটাকেই আপন মনে হচ্ছিল তখন।

আচ্ছা ঘুরে ফিরে এখানেই কেন ফিরে এলাম? এখানে তো আপন বলে কেউ নেই, সবই তো আমার অপরিচিত। সবকিছুই তো মিথ্যে......






 
;